জাতীয় পত্রিকার কার্টুনিস্ট পদে চাকরি পাবার জন্য গত এক বছর ধরে চেষ্টা করছি। বাড়িতে বসে নানান রকম কার্টুন প্র্যাকটিস করেছি, অ্যানিমে এঁকেছি, কিন্তু ইন্টারভিউ দেয়ার সাহস পাইনি। এবার ভাবলাম দেরি না করে একটা ইন্টারভিউ দিয়েই ফেলি। সন্ধ্যায় একটা অ্যানিমে সিরিজ দেখছিলাম। ভাবলাম এনিমের মূল ক্যারেক্টার সাতোরু ফুজিনুমাকে আঁকবো। আঁকতে শুরু করেছি এর মধ্যেই বিদ্যুৎ চলে গেল। আজকাল বিদ্যুৎ আর বৃষ্টি কখন আসে কখন যায় তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। টর্চ জ্বালিয়ে কাজ চালাতে হলো। কালকে সকাল এগারোটায় দৈনিক বাংলাদেশ পত্রিকার মঙ্গলবারের ম্যাগাজিনের জন্য কার্টুনিস্টদের ডেকেছে। সেটাতেই ইন্টারভিউ দেবো ভেবেছি।
এমনিতে আমার চেহারা ভেজা কাকের মতো। তাই সকাল সকাল উঠে পরিচ্ছন্ন হয়ে সুন্দর জামাকাপড় পরে নিলাম। সোয়া দশটায় বেরিয়ে একটা রিকশা নিয়ে রওনা হলাম পত্রিকার হেডকোয়াটারের দিকে। পনের মিনিটেই পৌঁছে গেলাম। রিকশা ভাড়া দিয়ে চলে গেলাম দোতলায়। দেখি প্রায় এক কুড়ি লোক সারি দেয়া চেয়ারে বসে আছে। বুঝে গেলাম, তারা আমার প্রতিদ্বন্দ্বী হবে। আমার পালা আসতে প্রায় ঘণ্টাখানেক লেগে গেল। পিওনগোছের একটা লোক আমার নাম ধরে ডাকলো। ভারী দরজা খুলে ঢুকে দেখলাম মস্ত বড় টেবিলের ওপাশে তিনজন ভারিক্কি চেহারার মানুষ বসা। তিনজনের মধ্যে একজন নারী। সদ্য আঁকা কয়েকটা কার্টুন দেখালাম। দুইজন প্রশংসা করলেও মাঝেরজন চোখ সরু করে বললেন, আমার ধারণা কিছুদিন পরে তুমি আরো ভালো আঁকতে পারবে। বুঝলাম, এ চাকরি আমার কপালে নেই।
মনকে সান্ত্বনা দিয়ে কাজের দিকে রওনা হলাম। চব্বিশ বছরের যুবকের কিছু একটা করা উচিৎ। তাই আমি একটা পিৎজা রেস্তোঁরায় কাজ নিয়েছি। পড়াশোনার জন্য ঢাকা ছেড়ে খুলনায় এসেছিলাম। পড়াশোনার খরচটা চালানোর জন্য হলেও কিছু একটা করা উচিৎ। আমাদের পিৎজা রেস্তোঁরাটা খুব জনপ্রিয়। আমি সেখানকার ডেলিভারি বয়। আমার মতো আরো তিনজন ডেলিভারি বয় আছে - মিরাজ, নিশিতা ও ফয়সাল। এর মধ্যে নিশিতা ভয়ঙ্কর চঞ্চল। একদম কিশোরীদের মতো।
রেস্তোরায় গিয়ে দেখি আমার নামে তিনটে হোম ডেলিভারি বসে আছে। হোম ডেলিভারিতে যেতে আমার একদম ভালো লাগে না। ভদ্রলোকেরা মনে করে ডেলিভারি বয় হলো পথের ভিখারি। যা তা ব্যবহার করে। তবে অফিসের লোকজন বেশ ভালো। আমি তাই অফিসের ডেলিভারিগুলো দিতে পছন্দ করি। মেজাজ খারাপ করেই আশি সিসি’র মোটরবাইকটা নিয়ে রওনা হলাম। তেঁতুলতলা মোড়টা ছাড়িয়েই মনে হতে লাগলো সামনে কিছু একটা খারাপ ঘটনা ঘটতে চলেছে। শিববাড়ি মোড়ে পৌঁছে তাকিয়ে দেখি স্কুলড্রেস পরে একটা শিশু সড়কদ্বীপ থেকে সিটি সেন্টারের দিকে রাস্তা পার হচ্ছে, আর তখনই আমার পেছন দিক থেকে একটা ট্রাক উর্ধশ্বাসে ওভারটেক করে এগোলো সেদিকে। আমি আতঙ্কে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। আর দেখলাম আমার চোখের সামনে একটা ঘড়ির কাঁটা পেছনের দিকে ঘুরছে। কী করে যেন কী হয়ে গেল!
আমি তেঁতুলতলা মোড় থেকে বাইকের স্পিড বাড়িয়ে দিলাম। শিববাড়ি মোড়ের আগেই ট্রাকটাকে আসতে দেখলাম। দূর থেকে ডানহাত নেড়ে শিশুটাকে পার না হতে বললাম। কিন্তু সে হয়তো স্কুলের রাইম মুখস্ত করতে করতেই রাস্তায় হাঁটছে। ওদিকে ট্রাকটারও গতি কমছে না। মুহূর্তের মধ্যে পেছনে তাকিয়ে দেখি ড্রাইভারের মাথা ঝুলে আছে স্টিয়ারিং হুইলের উপর। চিৎকার করলাম, কোনো কাজ হলো না। আরেকবার চেষ্টা করার সময় মনে হলো, বেশ দেরি হয়ে গেছে। এখনও আমি ট্রাকের সামনে কিন্তু কিছুই করার নেই। কিছু না ভেবেই বাইকের স্টিয়ারিং বাঁদিকে নব্বই ডিগ্রি ঘুরিয়ে দিলাম। প্রচণ্ড জোরে ধাক্কার শব্দ শুনলাম। তারপর কী হলো কিছু মনে নেই। চোখ খুলে দেখি ... (চলবে)
ঋষাৎ হাসান : ৫ জুলাই ২০২০
Comments
Post a Comment